Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

Responsive Advertisement

বেনাপোলে উন্নয়নের মহাসড়কে অবহেলিত স্বাস্থ্যসেবা, অকালমৃত্যুর মিছিলে স্বজনহারা কান্না



বেনাপোল থেকে রাজু আহমেদ:

বেনাপোল স্থলবন্দর দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত। যে বন্দর প্রতি বছর সরকারের কোষাগারে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব যোগান দেয়, সেই বন্দরের পাশেই স্বাস্থ্যসেবার চরম দৈন্যদশা। সামান্য চিকিৎসা পেতেও এখানকার মানুষকে ছুটে যেতে হয় ১৫-২০ কিলোমিটার দূরের নাভারন অথবা ৫০ কিলোমিটার দূরের যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই অনেকের জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে, যা বেনাপোলবাসীর জন্য এক অন্তহীন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজস্ব আয়ের পাহাড়, স্বাস্থ্যসেবায় শূন্যতা

বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল স্থলবন্দরে ৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছিল, যা প্রায় ৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বেনাপোল বন্দর দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের বিপরীতে, এখানকার মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার এমন করুণ চিত্র সত্যিই অগ্রহণযোগ্য।

শ্রমিকদের হাহাকার: "আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে"

বেনাপোল স্থলবন্দরে হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করেন। পণ্য লোডিং-আনলোডিং, ট্রাক চালনা, কাস্টমস ও ফরোয়ার্ডিং এজেন্টের কাজসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তারা নিয়োজিত। কিন্তু তাদের জন্য জরুরি চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই।

বন্দরের একজন পণ্য লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক, সালাম মিয়া, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "আমরা দিনরাত খেটে সরকারের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমাদের সামান্য আঘাত লাগলেও ভালো চিকিৎসার জন্য যশোর দৌড়াতে হয়। অনেক সময় পথেই আমাদের সহকর্মীরা মারা যায়। মনে হয় যেন আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আমরা একটা আধুনিক হাসপাতাল চাই, যাতে করে আমাদের জীবন সুরক্ষিত থাকে।"

সড়ক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুর মিছিল: গত এক বছরে হতাহতের চিত্র

বেনাপোলে উন্নত চিকিৎসার অভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। গত এক বছরে (জুন ২০২৪ - মে ২০২৫) বেনাপোল এবং এর আশেপাশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ১০-১৫ জন ব্যক্তি নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে, আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে না পারার কারণে বা সঠিক সময়ে উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি একটি অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে নসিমনের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন এবং দুজন আহত হন। এছাড়া, ট্রাক্টরের ধাক্কায় বাইসাইকেল আরোহীর মৃত্যু এবং মোটরসাইকেল শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার চিত্র: নড়বড়ে অবকাঠামো, অপ্রতুল জনবল

বেনাপোলে বর্তমানে একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নত চিকিৎসার সরঞ্জাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় জনবলের তীব্র সংকট বিদ্যমান। অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, সিসিইউ, বা আধুনিক ডায়াগনস্টিক ল্যাবের মতো জরুরি সুবিধাগুলোর কোনোটিই এখানে নেই। ফলে জটিল রোগের ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হন যশোর বা খুলনা যেতে।

জনগণের জোরালো দাবি: একটি আধুনিক ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল

বেনাপোলের ব্যবসায়ী সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং সাধারণ জনগণ দীর্ঘদিন ধরে একটি আধুনিক ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের মতে, বেনাপোলে একটি ভালো হাসপাতাল স্থাপন হলে শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দারাই নন, ভারত থেকে আসা অনেক রোগীও উপকৃত হবেন। এতে দেশের স্বাস্থ্য পর্যটনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ: মানবিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বেনাপোলবাসী

বেনাপোলের স্বাস্থ্যসেবার এই করুণ চিত্র দ্রুত পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেনাপোলে একটি উন্নতমানের হাসপাতাল স্থাপনের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে একদিকে যেমন মানুষের দুর্ভোগ কমবে, তেমনি সীমান্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার মানও বৃদ্ধি পাবে। বেনাপোলবাসী এখন তাকিয়ে আছে একটি মানবিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়, যা তাদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ