Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

Responsive Advertisement

বেতন বৈষম্যের বেড়াজালে প্রাথমিক শিক্ষা – দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন বাংলাদেশের শিক্ষকরা!

 


নিজস্ব প্রতিবেদক:

 সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আজ থেকে শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের পূর্ণ কর্মবিরতি। প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ শিশুর শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলে শিক্ষকরা নেমেছেন তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা অবসানের আন্দোলনে। কিন্তু এই আন্দোলনের পেছনের মূল কারণ কী? অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড কেবল দেশের অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় পিছিয়েই নেই, বরং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এটি সর্বনিম্ন।

বেতন বৈষম্যের চিত্র:

বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে (মূল বেতন ১১ হাজার টাকা) বেতন পান। প্রধান শিক্ষকরা পান ১১তম গ্রেডে (মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা)। এর বিপরীতে, একই শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্য সরকারি দপ্তরে ১২তম এমনকি ১০ম গ্রেডেও নিয়োগ দেওয়া হয়। যেমন, স্নাতক বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন একজন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এবং নার্সরা ১০ম গ্রেডে বেতন পান। এমনকি অষ্টম শ্রেণি পাস একজন ড্রাইভারও পান ১২তম গ্রেডে। এই বেতন বৈষম্য প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র হতাশা তৈরি করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন বেতন:

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী:

 * মালদ্বীপ: প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রায় পাঁচ গুণ।

 * পাকিস্তান: শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট।

 * শ্রীলঙ্কা: শিক্ষকদের গড় বেতন ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট।

 * ভারত: রাজ্য ও বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা থাকলেও, ভারতের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। যেমন, ২০০৯ সালে উত্তর প্রদেশে শিক্ষকদের বেতন ছিল ২১৬ ডলার ৬৭ সেন্ট, এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান বেসিক বেতন ৩৪৭ ডলার ৯৬ সেন্ট।

তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশের প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষকের মাসিক মূল বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৯,৫০০ টাকার (১১,০০০ টাকা মূল বেতন + অন্যান্য ভাতা) সমতুল্য, যা প্রায় ১৭০ ডলারের কাছাকাছি (১ ডলার = প্রায় ১১৫ টাকা ধরে)। যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবানন (১৯.২৩ ডলার), লাওস (১৪৩.১৪ ডলার), ইয়েমেন (৭৮.৭৪ ডলার) এবং উজবেকিস্তান (৭৮.৭৪ ডলার) এর মতো কিছু দেশ ছাড়া, বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল।

শিক্ষকদের হতাশা ও দাবির যৌক্তিকতা:

শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই অপ্রতুল বেতনে তাদের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন। বেশিরভাগ শিক্ষকই ঋণে জর্জরিত। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করলেও বাংলাদেশে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি।

সরকারের প্রস্তাব ও শিক্ষকদের প্রত্যাখ্যান:

প্রাথমিক শিক্ষা মানোন্নয়নে গঠিত একটি পরামর্শক কমিটি (অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদের নেতৃত্বে) সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১২তম গ্রেডে উন্নীত করার সুপারিশ করেছিল। তারা 'সহকারী শিক্ষক' পদ বিলুপ্ত করে শুরুর পদকে 'শিক্ষক' হিসেবে ১২তম গ্রেডে এবং দুই বছর পর 'সিনিয়র শিক্ষক' হিসেবে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়। প্রধান শিক্ষকদের জন্য ১০ম গ্রেডের সুপারিশ করা হয়েছিল, যা উচ্চ আদালতের রায়েরও সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা শুরু থেকেই ১১তম গ্রেডের দাবিতে অনড়। তাদের যুক্তি, একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য দপ্তরে ১০ম গ্রেড দেওয়া হলে, প্রাথমিক শিক্ষকদের কেন ১৩তম বা ১২তম গ্রেডে আটকে রাখা হবে?

শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের এই বেতন বৈষম্য দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা। এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। করোনাকালীন শিখন ঘাটতি এবং ঘন ঘন ছুটির কারণে এমনিতেই পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের এই অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ফলে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, সামনে ঈদুল আজহার ছুটি এবং তার আগে এই আন্দোলন শিশুদের শিখন ঘাটতিকে আরও গভীর করবে।

শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সরকার ও শিক্ষক সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্রুত ফলপ্রসূ আলোচনা এবং একটি ন্যায্য ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি, যাতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ